সুমাইয়া রাঃ এর জীবনী ও শহীদ হওয়ার ঘটনা
সুমাইয়া রাঃ এর জীবনী ও শহীদ হওয়ার ঘটনা |
সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত হলেন ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বপ্রথম শহীদ। হযরত সুমাইয়া রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে আবু জাহেলের হাতে নিহত হন। তিনি ইয়াসির ইবনে আমিরের স্ত্রী এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মাতা ছিলেন, যারা প্রাথমিক ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তার নির্যাতন ও নিহত হওয়ার ঘটনা ইবনে ইসহাক রচিত সীরাতের বইয়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে।
রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু তাআ'লা আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের দাওয়াতের শুরুতে ৬১০ খ্রিঃ মক্কার একদম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকেরাই প্রথম দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত বা খাইয়াত (রাঃ), হযরত ইয়াসির বিন আমের (রাঃ), হযরত বেলাল ইবনে রাবাহ (রাঃ) ছিলেন মক্কার সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোক। তারাই শুরুতে এ দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণে মুখোমুখি হন চরম নির্যাতনের।
ইসলাম গ্রহনের সময় হযরতে সুমাইয়া রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা তখন ষাটোর্ধ বৃদ্ধা, মক্কার আবু হোযায়ফা ইবনে আল মুগীরা ইবনে আল মাখযুমীর দাসী। রাসূলে করিম (সাঃ) দ্বীনে ইসলাম প্রচার করার সাথে সাথে হযরত সুমাইয়া (রাঃ) ও তার স্বামী ইয়াসির (রাঃ) ছেলে আম্মার (রাঃ) মুসলমান হয়ে যান।
হযরত সুমাইয়া (রাঃ) ছিলেন শুরুর দিক থেকে ইসলাম গ্রহণ করার মাঝে ১৭ তম। ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত সুমাইয়া (রাঃ) এর উপর আবু জাহেলের চরম অত্যাচারের মাত্রা কে দেখে আহা!!!
আবু জাহেল তাদেরকে মক্কার আল-বাতহা উপত্যকার মরুভূমির তপ্তবালুর মাঝে লোহার পোশাক পরিয়ে শুইয়ে রাখত। যেহেতু হযরত সুমাইয়া (রাঃ) এর কোন নিজস্ব গোত্র ছিল না তাই আবু জাহেল তার ইচ্ছামত হযরত সুমাইয়া (রাঃ) কে অত্যাচার করত।
মজলুম হযরত সুমাইয়া (রাঃ) এবং তার পরিবারের উপর হীনতর অমানবিক নির্যাতনের বলি, দুপুরের জ্বলসানো কড়া রোদে উত্তপ্ত মরুভূমিতে শায়িত করে জুলুম করত চির জাহান্নামী জালিম মুশরিক মালাওন আবু জাহেল।এহেন নির্মম অত্যাচার দেখে দয়াল নবীজী (সাঃ) কান্না করে করে তখন বলতেন- ‘হে ইয়াসিরের পরিবার- পরিজন! ধৈর্য্য ধর। তোমাদের জন্য সুসংবাদ। তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত! ”
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন হযরত সুমাইয়া (রাঃ) কে জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন তখন হযরত সুমাইয়া (রাঃ) রাসূল (সাঃ) কে বলতেন- “ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আমি জান্নাতের সুগন্ধ এই তপ্ত মরুভূমির বুকে শুয়েই পাচ্ছি। ’
দীর্ঘদিন অত্যাচার নির্যাতন করার পরও যখন হযরত সুমাইয়া (রাঃ) দ্বীন ইসলাম পরিত্যাগ করলেন না তখন একদিন সন্ধ্যায় আবু জাহেল চরম অশালীন, অত্যন্ত নোংরা, অকথ্য জঘন্য অসভ্য ভাষায় গালি গালাজ করার এক পর্যায়ে তার দিকে বর্শা ছুড়ে মারে এবং এটি সুমাইয়া (রাঃ) এর লজ্জাস্থানে আঘাত করলে তিনি তাৎক্ষণিক শাহাদত বরণ করেন। আহা কি মর্মান্তিক!!! আল্লাহ! আল্লাহ!
৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে অর্থ্যাৎ নবীয়ে পাক (সাঃ) এর নবুয়্যত ঘোষনার পাঁচ বৎসর পর হযরত সুমাইয়া (রাঃ) শাহাদাত বরন করেন পরপরই আবু জাহেল উনার স্বামী হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাঃ) কেও তীর বিদ্ধ করে শহীদ করে।
বদর যুদ্ধে আবু জাহেল নিহত হলে প্রিয় হাবীব (সাঃ) হযরত সুমাইয়া (রাঃ) এর ছেলে হযরত আম্মার রাদিয়াল্লাহু তাআ'লা আনহুকে বলেন- “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমার মায়ের ঘাতককে হত্যা করেছেন।”
হযরত সুমাইয়া রাঃ এর পরিচয়
সুমাইয়া বিনতে খাব্বাতের বংশ পরিচয় তেমন পাওয়া যায়নি। ইবনে সাদ বলেন, তাঁর পিতার নাম খাব্বাত। কিন্তু বালাজুরী বলেন তাঁর পিতার নাম খাইয়াত। শুরুর দিকে তিনি মক্কার আবু হুজাইফা বিন আল-মুগীরা আল মাখযুমীর দাসী ছিলেন।তিনি ছিলেন একজন হাবশী বা আবিসিনীয় ( বর্তমান ইথিওপিয়া ) কৃষ্ণাঙ্গ দাসী।
হযরত সুমাইয়া রাঃ এর জীবনী
ওয়াকিদীসহ একদল বংশবিদ্যা বিশারদ বলেন, তাঁর স্বামী ইয়াসির ইবনে আমির ইয়ামেনের মাজহাজ গোত্রেরআনসী শাখার সন্তান ছিলেন। ইয়াসির ইবনে আমির তার দুভাই হারিস ইবনে আমির ও মালিক বিন আমিরকে সঙ্গে নিয়ে তাদের নিখোঁজ চতুর্থ ভাইয়ের সন্ধানে এলে ইয়াসির মক্কায় থেকে যান এবং আবু জেহেলের চাচা আবু হুযায়ফা ইবনে আল মুগীরা আল মাখযুমীর সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন।
আবু হুজাইফা তার দাসী সুমাইয়া বিনতে খাব্বাতকে ইয়াসিরের সাথে বিয়ে দেন এবং এই ঘরেই আম্মার ইবনে ইয়াসিরের জন্ম হয়।
হযরত সুমাইয়া রাঃ ইসলাম গ্রহণ
সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত যখন বার্ধক্যের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েন তখন মক্কায় ইসলামের দাওয়াতের সূচনা হয়। তিনি প্রথমভাগেই স্বামী ইয়াসির ও ছেলে আম্মার ইবনে ইয়াসিরসহ গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পরেই প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। ফলে তার পরিবার কুরাইশদের অত্যাচারের রোষানলে পড়ে যায়।
ইমাম আহমাদ ও ইবনে মাজাহ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন, সর্বপ্রথম যে সাতজন প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দান করেন, তারা হলেন, মুহাম্মাদ সা., আবু বকর, আম্মার ইবনে ইয়াসির, সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত,সুহাইব ইবনে সিনান আর রুমি, বিলাল ও আল মিকদাদ।
সুমাইয়া রাঃ এর অত্যাচারের শিকার
মক্কায় হযরত সুমাইয়ার পরিবারের উপর কুরাইশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহায্য করার মত কেউই ছিলো না (যেহেতু তাঁরা বহিরাগত ও দাস ছিলেন)। তাই তারা বহু নির্মম অত্যাচারের শিকার হন। মক্কার আবু জাহেল ও তার সঙ্গী কুরাইশরা সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত অত্যাচার করত। তবে মুহাম্মাদ সা. তার চাচা আবু তালিব ও আবু বকরের দ্বারা তাদের নিরাপত্তার চেষ্টা করেন। আম্মারের পরিবার ও তার মা সুমাইয়া বিনতে খাব্বাতের উপর অত্যাচারের নমুনা:
কুরাইশগণ তাদের পরিবারের সকলকে লোহার বর্ম পরিয়ে প্রচন্ড রোদে দাড় করিয়ে রাখতো। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, একদিন মুহাম্মাদ যাত্রা পথে আম্মার ইবনে ইয়াসিরের পরিবারকে শাস্তি দিতে দেখেন। এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। উসমান ইবনে আফনান নিজেও আম্মারের পরিবারের উপর অত্যাচারের সাক্ষ্য দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে জাফর বলেন, মুহাম্মাদ তাদের অত্যাচারিত অসহায় অবস্থায় দেখে বলেন, হে ইয়াসিরের পরিবারবর্গ ধৈর্য ধর! তোমাদের জন্য জান্নাত নির্ধারিত রয়েছে। ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, এই অত্যাচারের স সুমাইয়া, সুমাইয়ার স্বামী ইয়াসির ইবনে আমির ও ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াসির মৃত্যুবরণ করেন।
সুমাইয়া রাঃ এর মৃত্যু
হযরতে সুমাইয়া রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার জন্ম ৫৫০খ্রি শহীদ ৬১৫খ্রি। প্রতিদিনের মত সারাদিন অত্যাচার সহ্য করে সুমাইয়া বাড়ি ফিরেন। সন্ধ্যায় আবু জেহেল অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করার এক পর্যায়ে তার দিকে বর্শা ছুড়ে মারে এবং এটি তাঁর যৌনাঙ্গে আঘাত করলে মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই ইসলামের প্রথম শহীদ হন। তার এই শাহাদতের ঘটনাটি ঘটে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে।